
বাইতুল হিকমাহ: বাগদাদের অবিস্মরণীয় সেই লাইব্রেরি
ইতিহাসের পাতায় বাগদাদ নামটি গৌরবউজ্জ্বল হয়ে রয়েছে ইসলামের ইতিহাসে যে যুগটিকে বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য ও দার্শনিক অগ্রগতির স্বর্ণযুগ বলা হয়, সেই যুগের কেন্দ্রবিন্দু ছিল বাগদাদের একটি জ্ঞানকেন্দ্র, যা পরিচিত ছিল “বাইতুল হিকমাহ” নামে। বাইতুল হিকমাহ ছিল মধ্যযুগীয় পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লাইব্রেরি এবং অনুবাদ কেন্দ্র। এটি কেবল একটি জ্ঞানভাণ্ডারই ছিল না, বরং সভ্যতার বিকাশে এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
প্রতিষ্ঠার পটভূমি
বাইতুল হিকমাহ প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব আব্বাসীয় খলিফা হারুন আল রশিদ (৭৬৩–৮০৯ খ্রিষ্টাব্দ) এবং তাঁর পুত্র খলিফা আল-মামুনের (৭৮৬–৮৩৩ খ্রিষ্টাব্দ) প্রেরণায় সূচিত হয়। হারুন আল রশিদ ৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দে বাইতুল হিকমাহর ভিত্তি স্থাপন করেন, যা পরবর্তীতে আল-মামুনের আমলে (৮১৩–৩৩ খ্রিষ্টাব্দ) আরও সমৃদ্ধ হয়। হারুন আল রশিদ ছিলেন এক প্রগতিশীল শাসক, যিনি শিক্ষা, বিজ্ঞান ও শিল্পকলার প্রতি বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। আল-মামুন তাঁর বাবার দেখানো পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে এই লাইব্রেরিকে একটি বৈশ্বিক জ্ঞানকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলেন।
(তথ্যসূত্র: A. M. S. al-Baghdadi, “The House of Wisdom,” 1970)
কাঠামো ও কার্যক্রম
বাইতুল হিকমাহ শুধু একটি লাইব্রেরি ছিল না, এটি ছিল একটি বহুমুখী জ্ঞানকেন্দ্র। এখানে ছিল:
লাইব্রেরি: লক্ষাধিক পাণ্ডুলিপি ও গ্রন্থের এক মহাসমাহার।
অনুবাদ কেন্দ্র: গ্রিক, পার্সিয়ান, ভারতীয় এবং সিরিয়ান ভাষার বহু গ্রন্থ আরবিতে অনূদিত হয়েছিল।
গবেষণা কেন্দ্র: এখানে বিজ্ঞান, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র এবং দর্শনের উপর গবেষণা চালানো হতো।
বিজ্ঞানাগার: রসায়ন, পদার্থবিদ্যা এবং চিকিৎসা বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার ব্যবস্থা ছিল।
(তথ্যসূত্র: George Saliba, “Islamic Science and the Making of the European Renaissance,” 2007)
অনুবাদের স্বর্ণযুগ
বাইতুল হিকমাহর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক ছিল এর অনুবাদ কার্যক্রম। খলিফা আল-মামুন এর নেতৃত্বে “অনুবাদের স্বর্ণযুগ” সূচিত হয়। ৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বাইতুল হিকমাহকে একটি অনুবাদ কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করেন। গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল, প্লেটো, হিপোক্রেটস, গ্যালেন এবং টলেমির মতো মনীষীদের গ্রন্থ এখানে আরবিতে অনূদিত হয়।
অনুবাদকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন:
হুনাইন ইবনে ইসহাক (৮০৯–৭৩ খ্রিষ্টাব্দ): যিনি গ্যালেন এবং হিপোক্রেটসের চিকিৎসা বিষয়ক গ্রন্থ অনুবাদ করেছিলেন।
আল-খোয়ারিজমি (৭৮০–৮৫০ খ্রিষ্টাব্দ): গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর অসাধারণ কাজ করেছিলেন।
কিন্দি (৮০১–৭৩ খ্রিষ্টাব্দ): যিনি গ্রিক দর্শন ও বিজ্ঞানকে আরবিতে রূপান্তরিত করেন।
(তথ্যসূত্র: Dimitri Gutas, “Greek Thought, Arabic Culture,” 2001)
জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র
বাইতুল হিকমাহতে যে জ্ঞানচর্চা হতো, তা কেবল অনুবাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এখানে মুসলিম ও অমুসলিম পণ্ডিতদের একত্রে কাজ করার সুযোগ ছিল। তাদের গবেষণার ফলাফল মধ্যযুগীয় ইউরোপের রেনেসাঁ আন্দোলনে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল। উদাহরণস্বরূপ:
আল-খোয়ারিজমি এখানে বসেই গণিতের “আলজেব্রা” শাখার বিকাশ ঘটান।
আল-হাইথাম (৯৬৫–১০৩ খ্রিষ্টাব্দ): আলোকবিজ্ঞানের উপর তাঁর গবেষণা শুরু করেন।
চিকিৎসাশাস্ত্রে মুসলিম গবেষণার ভিত্তি এখান থেকে গড়ে ওঠে।
(তথ্যসূত্র: Toby Huff, “The Rise of Early Modern Science: Islam, China, and the West,” 1993)
ধ্বংস এবং প্রভাব
১২৫৮ সালে মঙ্গোল শাসক হুলাগু খানের নেতৃত্বে বাগদাদ আক্রমণ করা হয়। এই আক্রমণে বাইতুল হিকমাহ সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে যায়। লক্ষাধিক পাণ্ডুলিপি ও বই টাইগ্রিস নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। কথিত আছে, নদীর জল কালো হয়ে গিয়েছিল বইয়ের কালি ও পাণ্ডুলিপির রঙে।
যদিও বাইতুল হিকমাহ ধ্বংস হয়ে গেছে, কিন্তু এর প্রভাব অমর। এই লাইব্রেরি মধ্যযুগের মুসলিম সভ্যতার শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক এবং তা প্রমাণ করে, জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার মাধ্যমে মানবসভ্যতা কতদূর অগ্রসর হতে পারে।
(তথ্যসূত্র: Hugh Kennedy, “The Court of the Caliphs: The Rise and Fall of Islam’s Greatest Dynasty,” 2004)
বাইতুল হিকমাহ ছিল এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যা শুধুমাত্র ইসলামী সভ্যতাকেই নয়, সমগ্র বিশ্বের জ্ঞানচর্চার ধারাকে সমৃদ্ধ করেছে। আজকের আধুনিক বিশ্বে এই লাইব্রেরির শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার আদর্শ নতুন প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করতে পারে। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার পথে বিনিয়োগ কখনোই ব্যর্থ হয় না।