ডাংগুলি- শৈশব এর হারিয়ে যাওয়া এক খেলা

শৈশবে ডাংগুলি খেলেননি এমন মানুষের সংখ্যা নেহাতই কম। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী ও জনপ্রিয় খেলা “ডাংগুলি” এখন প্রযুক্তির ভিড়ে হারিয়ে যেতে বসেছে। এক সময় এই খেলাটি ছিল গ্রামের শিশুদের অন্যতম প্রধান বিনোদনের মাধ্যম, কিন্তু এখন প্রযুক্তির উন্নতির কারণে মোবাইল ফোন এবং কম্পিউটার গেমসের ভিড়ে ডাংগুলি প্রায় বিলুপ্তির পথে।

ডাংগুলি খেলার ইতিহাস

ডাংগুলি খেলা শুরু হয়েছিল প্রায় ২৫০০ বছর আগে মৌর্য আমল থেকে। এটি শুধু বাংলা বা ভারতীয় উপমহাদেশেই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয় ছিল। বিভিন্ন দেশে এটি বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। যেমন, ইংরেজিতে টিপক্যাট, নেপালি ভাষায় দান্দি-বিয়ো, ওড়িশায় গুলি-বদি, বাংলায় ডাংগুলি বা ড্যাংবাড়ি, এবং তামিলে কিট্টি-পাল ইত্যাদি নামে পরিচিত।

খেলার উপকরণ এবং নিয়মাবলী

ডাংগুলি খেলতে খুব বেশি সরঞ্জামের প্রয়োজন হয় না। সাধারণত একটি বড় লাঠি (ডান্ডা) এবং একটি ছোট লাঠি (গুলি) দিয়েই খেলা হয়। ডান্ডার দৈর্ঘ্য প্রায় দেড় থেকে দুই ফুট লম্বা হয় এবং গুলির দৈর্ঘ্য প্রায় দুই ইঞ্চি হয়, যার দুই প্রান্ত কিছুটা সুচাল করা থাকে। খেলার মাঠে ছোট একটি গর্ত করে গুলিটি সেখানে রাখা হয় এবং ডান্ডা দিয়ে আঘাত করে গুলিটি দূরে পাঠানো হয়।

প্রতিপক্ষ দল গুলিটি ধরার চেষ্টা করে। যদি তারা গুলি মাটিতে পড়ার আগেই ধরে ফেলতে পারে, তাহলে খেলোয়াড় আউট হয়। আর যদি তারা তা না পারে, খেলোয়াড় ডান্ডা দিয়ে গুলির দূরত্ব মাপে। সাতটি মাপ (বাড়ি, দুড়ি, তেড়ি, চাঘল, চাম্পা, ঝেঁক, মেক) মেপে পূর্ণ করলে একটি গুট বা ফুল হয়, আর সাতটি ফুল হলে একটি লাল হয়। যেই দলের গুট ও লাল বেশি হয়, সেই দল খেলায় জয়ী হয়।

ডাংগুলি খেলার জনপ্রিয়তা ও বর্তমান অবস্থা

ডাংগুলি এক সময় বাংলার গ্রামাঞ্চলে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। কিশোর-কিশোরীরা স্কুল থেকে ফিরে এসে দল বেঁধে মাঠে এই খেলা খেলত। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে কালের আবর্তে ডাংগুলি খেলার সেই দৃশ্য এখন আর খুব একটা দেখা যায় না। স্মার্টফোন ও কম্পিউটার গেমের দখলে গ্রামীণ খেলাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তির কারণে কিশোর-কিশোরীরা মাঠের খেলা থেকে দূরে সরে গিয়ে অনলাইন গেমের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে।

তবে আশার কথা, কিছু সংগঠন এবং প্রতিষ্ঠান ঐতিহ্যবাহী খেলাগুলো পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ২০১৭ সালে ভারতের গুজরাটে গিল্লি ডান্ডা টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হয়েছিল। এছাড়া ইউনেস্কো এবং আন্তর্জাতিক কাউন্সিল অব ট্র্যাডিশনাল স্পোর্টস অ্যান্ড গেমস (ICTSG) ঐতিহ্যবাহী খেলার পুনরুদ্ধার ও প্রচারের জন্য কাজ করে যাচ্ছে।

ডাংগুলি খেলা আমাদের শৈশবের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। যদিও এই খেলা আজ বিলুপ্তির পথে, তবু আমরা আশাবাদী যে ভবিষ্যতে এ খেলার প্রতি পুনরায় আগ্রহ তৈরি হবে এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্মও এই ঐতিহ্যবাহী খেলাকে নতুন করে আবিষ্কার করবে। আমাদের হারিয়ে যাওয়া শৈশব এবং সংস্কৃতিকে ফিরিয়ে আনতে ডাংগুলি খেলাকে পুনরুদ্ধার করা অত্যন্ত জরুরি।

Share with others

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *