ঢাকাই মসলিন, একসময় বিশ্বের সবচেয়ে সুক্ষ্ম ও মূল্যবান বস্ত্র হিসেবে পরিচিত ছিল, যা বাংলার গর্ব এবং শিল্পকলার অন্যতম উদাহরণ। এই মসলিন কাপড়ের সূক্ষ্মতা, মসৃণতা এবং অনন্য নকশা এমনভাবে তৈরি করা হতো, যা পৃথিবীর আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যেত না। একসময় ঢাকাই মসলিন ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে শুরু করে মুঘল সম্রাটদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় ছিল। আজ সেই মসলিনের ঐতিহ্য প্রায় হারিয়ে গেলেও, এর ইতিহাস এবং প্রাচীন কালের গৌরবময় অবদান অমলিন।
মসলিনের উৎপত্তি এবং প্রসার
ঢাকাই মসলিনের উৎপত্তি হয়েছিল বাংলার ঢাকায়, যা আজকের বাংলাদেশের রাজধানী। এই বস্ত্রের খ্যাতি প্রথমেই উঠে আসে মুঘল আমলে। ধানমন্ডি, বিক্রমপুর, সোনারগাঁও, এবং নারায়ণগঞ্জের কারিগররা ছিলেন মসলিন তৈরির মূল কারিগর। মসলিন তৈরির প্রধান কাঁচামাল ছিল সুতি সুতা, যা স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বিশেষ ধরনের সুতির গাছ থেকে সংগ্রহ করা হত।
মসলিনের সূক্ষ্মতা এতটাই ছিল যে এটি বাতাসে ভেসে বেড়াতে পারত এবং এটি এত হালকা ও স্বচ্ছ ছিল যে একগজ কাপড় আঙ্গুলের আংটিতে গুটিয়ে নেওয়া যেত। এই কারণেই মসলিনকে একসময় “বায়ুনুল” (বায়ুর মতো হালকা) বলা হতো।
মুঘল সম্রাট এবং ঢাকাই মসলিন
মুঘল আমলে ঢাকাই মসলিন ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়। মুঘল সম্রাটরা ঢাকার মসলিন কাপড়কে নিজেদের পোশাক হিসেবে বেছে নিতেন, বিশেষ করে নরম এবং সূক্ষ্ম কাপড় সম্রাটদের এবং তাদের রানীদের জন্য উপযুক্ত মনে করা হতো। সম্রাট জাহাঙ্গীর এবং শাহজাহানও ঢাকাই মসলিনের প্রশংসক ছিলেন। মুঘল সম্রাটদের রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মসলিনের চাহিদা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, তখনকার সময়ে মসলিন উৎপাদনের জন্য বিশেষ কারিগরদের ঢাকার কাছে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে বাধ্য করা হতো।
ঢাকাই মসলিনের আন্তর্জাতিক খ্যাতি
মসলিনের খ্যাতি ভারতীয় উপমহাদেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল ইউরোপে। ইউরোপীয় অভিজাত এবং ধনীরা মসলিনকে অত্যন্ত মূল্যবান এবং আরামদায়ক হিসেবে গ্রহণ করতেন। ব্রিটিশরা মসলিন কাপড়কে ইউরোপে রপ্তানি করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করত। এমনকি ফরাসি এবং ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্যরাও ঢাকাই মসলিনের পোশাক ব্যবহার করতেন।
ঢাকাই মসলিনের ধ্বংস
১৮শ এবং ১৯শ শতাব্দীতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে ঢাকাই মসলিন ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয়। ব্রিটিশরা ভারতে তাদের নিজেদের টেক্সটাইল ব্যবসা বাড়ানোর জন্য ঢাকাই মসলিন শিল্পকে নিষ্পেষিত করেছিল। ব্রিটিশরা স্থানীয় বস্ত্রশিল্পকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য উচ্চ কর আরোপ করত এবং স্থানীয় কারিগরদের উপর অমানবিক অত্যাচার চালাত।
এই পরিস্থিতিতে, অনেক মসলিন কারিগর তাদের পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। তাছাড়া, মসলিন তৈরির বিশেষ সুতার গাছগুলোও ধ্বংস হয়ে যায়, যার ফলে মসলিন শিল্পের অবসান ঘটে। ফলে, একটি গৌরবময় শিল্পকলা ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে চলে যায়।
ঢাকাই মসলিনের পুনর্জাগরণ
বর্তমানে, ঢাকাই মসলিনের ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের গবেষক এবং বস্ত্রশিল্প বিশেষজ্ঞরা মসলিনের প্রাচীন কৌশলগুলো পুনরায় উদঘাটনের চেষ্টা করছেন। এছাড়া, নতুন প্রজন্মের মধ্যে মসলিন কাপড়ের জনপ্রিয়তা আবার ফিরে আসছে। অনেক ফ্যাশন ডিজাইনার এবং কারুশিল্পীরা মসলিনের নকশা এবং কৌশল পুনরুদ্ধার করার মাধ্যমে বাঙালির এই হারানো ঐতিহ্যকে আবারও জীবন্ত করার জন্য কাজ করছেন।
[…] হয়ে উঠেছিল। ঢাকার বিখ্যাত মসলিন কাপড়ের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল […]