আমাদের প্রিয় মধুদা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের একপ্রান্তে, কলাভবনের উত্তর-পূর্ব কোণে দাঁড়িয়ে আছে এক চায়ের দোকান—‘মধুর ক্যান্টিন’। নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা হয়তো জানেন না, এই ক্যান্টিনের নাম যার নামে, তিনি কে ছিলেন।

নাম ছিল মধুসূদন দে, সবাই ডাকত মধুদা। ১৯১৯ সালের এপ্রিলে জন্ম মধুসূদন দের। তাঁর বাবা আদিত্যচন্দ্র ছিলেন এক সাধারণ খাবারের দোকানদার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ব্যবসা করতেন। তখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কলাভবন ছিল আজকের ঢাকা মেডিকেল কলেজের জায়গায়। পাশে ছিল পুলিশ ব্যারাক, আর পুরো ক্যাম্পাসজুড়ে ছড়িয়ে ছিল ছোট ছোট কুঁড়েঘর।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কয়েক বছর পর, ব্রিটিশ সরকার যখন ক্যাম্পাস পরিষ্কার করতে শুরু করল, তখন আদিত্যচন্দ্র পুলিশের কাছ থেকে দুটি ছনের ঘর কিনে নিলেন। একটিতে নিজে থাকতেন, আর অন্যটিতে বিক্রি করতেন চা-সিঙাড়া। কখনো কখনো নিজ হাতে মিষ্টিও বানাতেন।

এই সামান্য দোকানেই একসময় বসে থাকতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা, চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে চলত তর্ক-বিতর্ক, সাহিত্যচর্চা মধুসূদনের দায়িত্ব নেওয়া ও ব্যবসার শুরু ১৯৩৪ সালে, মাত্র ১৫ বছর বয়সে, মধুসূদন বাবার ব্যবসার কাজে হাত লাগান। কিন্তু ১৯৩৯ সালে বাবা আদিত্যচন্দ্র পক্ষাঘাতে মারা গেলে পুরো দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর কাঁধে।

প্রথমে বাবার সেই ছনের ঘরেই ব্যবসা চালান মধুসূদন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পাসে একটি ক্যান্টিনের প্রয়োজন অনুভব করে। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পুরোনো ইটের ভবন, যা একসময় ছিল নবাবদের নাচঘর, সেটি মধুসূদন দেকে দেওয়া হয়।

সেখানেই শুরু হয় নতুন অধ্যায়—‘মধুর মধুর ক্যান্টিন

আন্দোলনের সূতিকাগার মধুর ক্যান্টিন কখনো শুধুই ক্যান্টিন ছিল না। এটি হয়ে উঠেছিল রাজনীতি, বিপ্লব আর প্রতিবাদের কেন্দ্র।

সকালবেলা মধুদাকে ক্যান্টিনে পাওয়া যেত না। তিনি সাধারণত দুপুরের পর আসতেন, এসে কর্মচারীদের জিজ্ঞেস করতেন,

“আইজকা মোয়াজ্জেম সাব আইছিল?”

যদি উত্তর আসত, “হ।”

তাহলেই মধুদা বলতেন, “লেখো বিশ কাপ চা।”

তারপর জিজ্ঞাসা করতেন, “জাফর সাব?”

“হ।”

“লেখো পনেরো কাপ।”

এইভাবে ছাত্রনেতাদের নাম ধরে ধরে বাকির খাতায় হিসাব রাখতেন। কিন্তু সত্যি বলতে, কার কয় কাপ চা খাওয়া হয়, সেটি তিনি জানতেন না। অনুমান করেই সংখ্যাগুলো লিখে রাখতেন। আহমদ ছফা তাঁর এক লেখায় লিখেছেন—“টাকাটা আদায় হতো কি না, আমার মধুদার শেষ দিন

একদিকে শিক্ষার্থীদের প্রতি মধুর ভালোবাসা, আর অন্যদিকে ছাত্রদের আন্দোলনের প্রতি মধুর সমর্থন—এসব কিছু পাকিস্তানি শাসকদের কাছে তাঁকে সন্দেহভাজন করে তুলেছিল।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে যখন পাকিস্তানি সেনারা অপারেশন সার্চলাইট চালায়, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল তাদের প্রধান লক্ষ্যগুলোর একটি।

পরদিন সকালে সেনারা আক্রমণ করে জগন্নাথ হলের পাশের শিববাড়ি কোয়ার্টার, যেখানে পরিবার নিয়ে থাকতেন মধুদা।

তাঁকে ঘর থেকে টেনে বের করে এনে গুলি চালানো হয়। স্বামীকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেন স্ত্রী, সেও গুলিবিদ্ধ হন। সেদিন মধুদার পুত্র ও পুত্রবধূও সেনাদের হাতে প্রাণ একটি ভাস্কর্য, এক ভালোবাসা

আজ মধুর ক্যান্টিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মধুসূদন দের একটি ভাস্কর্য। তাতে লেখা আছে—

“আমাদের প্রিয় মধুদা”।

একজন সাধারণ মানুষ, যিনি শুধুই চা বিক্রেতা ছিলেন না, ছিলেন ইতিহাসের এক নীরব সাক্ষী।

#modhuda #dhaka #dhakauniversity #history #modhurcanteen

Share with others

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *