বাংলার রাজধানী স্থানান্তরের ইতিহাস

যেভাবে ঢাকার মসলিন শিল্প এবং বাণিজ্য পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হয়।

বাংলার রাজধানী স্থানান্তরের কাহিনী এক পরিবর্তনশীল ইতিহাসের দলিল, যা সময় ও পরিস্থিতির চাহিদা অনুযায়ী বাংলার ভূ-রাজনীতিতে গভীর পরিবর্তন এনেছে। মুঘল আমল থেকে ব্রিটিশ শাসন—এই দীর্ঘ সময়ে বাংলার রাজধানী একাধিকবার স্থানান্তরিত হয়েছে। ঢাকা, মুর্শিদাবাদ এবং কলকাতা—প্রতিটি শহরই তাদের সময়ে বাংলার শাসন, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল।

মুঘল আমলে ইসলাম খাঁর নেতৃত্বে ১৬১০ সালে বাংলার রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। ঢাকাকে রাজধানী করার পেছনে অন্যতম কারণ ছিল এর কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থান। ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার সংযোগস্থলে অবস্থিত ঢাকা ছিল নৌপরিবহন ও বাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আরাকান এবং পর্তুগিজ জলদস্যুদের আক্রমণ ঠেকাতে ঢাকার প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান মুঘল শাসকদের কাছে বিশেষ সুবিধাজনক মনে হয়েছিল।

ঢাকা তখন শুধু প্রশাসনিক কেন্দ্র নয়, বরং সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। ঢাকার বিখ্যাত মসলিন কাপড়ের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল ইউরোপের রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত। কিন্তু ঢাকার এই স্বর্ণযুগ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৭০৪ সালে, মুর্শিদ কুলি খাঁ যখন মুর্শিদাবাদে রাজধানী স্থানান্তর করেন, তখন থেকেই ঢাকার গুরুত্ব ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে।

১৭০৪ সালে ঢাকার পরিবর্তে মুর্শিদাবাদ বাংলার রাজধানী হয়। নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ এই স্থানান্তরের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন। ঢাকার তুলনায় মুর্শিদাবাদ ছিল গঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত, যা বাণিজ্য এবং যোগাযোগের জন্য অধিক সুবিধাজনক। সেই সময়ে মুর্শিদাবাদ বাংলার বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে।

মুর্শিদাবাদে রাজধানী স্থানান্তরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল নবাবের নিজস্ব প্রভাব বিস্তার। ঢাকার তুলনায় মুর্শিদাবাদ নবাবের জন্য রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক দিক থেকে সুবিধাজনক ছিল। মুর্শিদাবাদ দ্রুত একটি সমৃদ্ধ নগরীতে পরিণত হয়, যেখানে নবাবের জাঁকজমকপূর্ণ দরবার, কারুকার্যখচিত প্রাসাদ, এবং নানা ধরনের বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড গড়ে ওঠে।

কিন্তু ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধ পর মুর্শিদাবাদের এই গৌরব ক্ষীণ হতে থাকে। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার শাসনভার নিজেদের হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুর্শিদাবাদের প্রভাব হারিয়ে যায়।

পলাশীর যুদ্ধের পর, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার প্রশাসনিক কেন্দ্র কলকাতায় স্থানান্তরিত করে। আনুষ্ঠানিকভাবে ১৭৭২ সালে এটি বাংলার রাজধানী হয়ে ওঠে। কলকাতাকে রাজধানী করার পেছনে ছিল ব্রিটিশদের বাণিজ্যিক এবং সামরিক কৌশল। গঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত এই শহরটি সমুদ্রবাণিজ্যের জন্য আদর্শ ছিল।

কলকাতা কেবল বাণিজ্যের জন্য নয়, ইউরোপীয়দের বসবাস এবং শাসনের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ শাসনের ফলে এখানে শিক্ষার প্রসার ঘটে, যা আধুনিক বাঙালি সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শহরটি একসময় ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী হয়ে ওঠে এবং ১৯১১ সাল পর্যন্ত এই মর্যাদা ধরে রাখে।

বাংলার রাজধানী স্থানান্তরের প্রভাব শুধু প্রশাসনিক পর্যায়েই সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং এটি সমাজ, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতিতেও পরিবর্তন এনেছে। ঢাকার গুরুত্ব হারানো মানে ছিল এর মসলিন শিল্প এবং ঐতিহ্যবাহী বাণিজ্যের পতন। মুর্শিদাবাদ, নবাবদের হাতছাড়া হওয়ার পর ধীরে ধীরে ব্রিটিশদের হাতে এক সাধারণ শহরে পরিণত হয়। অন্যদিকে, কলকাতা হয়ে ওঠে আধুনিক বাংলার প্রতীক।

ঢাকার মসলিন শিল্প, যা একসময় বাংলার গর্ব ছিল, রাজধানী স্থানান্তর এবং ব্রিটিশ শাসনের ফলে ধ্বংসের মুখে পড়ে। মুঘল আমলে ঢাকা ছিল বাংলার রাজধানী এবং মসলিন শিল্পের প্রধান কেন্দ্র। তবে ১৭০৪ সালে মুর্শিদ কুলি খাঁর রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর এবং পরবর্তীতে ব্রিটিশ শাসনে রাজধানী কলকাতায় স্থানান্তরের ঘটনা ঢাকার অর্থনীতিতে বিপর্যয় ডেকে আনে।

ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পর ১৭৭২ সালে রাজধানী কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়। এই স্থানান্তর ঢাকার মসলিন শিল্পকে আরও বড় সংকটের দিকে ঠেলে দেয়। কলকাতা হয়ে ওঠে ব্রিটিশ বাণিজ্যের কেন্দ্র, এবং ব্রিটিশরা বাংলার ঐতিহ্যবাহী শিল্পগুলোকে ধ্বংস করে নিজেদের তৈরি পণ্য প্রচারে মনোনিবেশ করে।

কলকাতার বন্দর শহর হিসেবে দ্রুত উত্থানের ফলে ঢাকার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পথ কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। ব্রিটিশরা ইউরোপে প্রস্তুতকৃত কাপড় সস্তায় বাংলায় আমদানি করতে থাকে এবং ঢাকার মসলিন শিল্প তাদের প্রতিযোগিতায় টিকতে পারেনি।

Share with others

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *