মেঘনা, ডাকাতিয়া, ধনাগোদা নদীর কোল জুড়ে ১৭০৪.০৬ বর্গ কি.মি. আয়তনের গভীর সবুজ ভূ-খন্ডের নাম চাঁদপুর। এই ভূখন্ডের বুকে নিরতিশয় যতন আর আদরের মাঝে বসবাস করে ২৬,০০,২৬৩ জন মানুষ। গগনের চাঁদ জ্যোৎস্না হয়ে ঝরে পড়ে এই সবুজ ভূখন্ডে। আচ্ছাদিত করে রাখে হাজার বছরের উচ্ছ্বাসিত সভ্যতার এক উন্নত জনপদকে। স্নিগ্ধ লাইটের উৎস হলো চাঁদ, লোকালয়, নিকেতন পক্ষান্তরে গ্রাম জনপদ হচ্ছে পুর। এ দুয়ের সমন্বয়ে গড়া জনপদ হলো চাঁদপুর। ফিরে তাকাই চাঁদপুরের ইতিহাস-ঐতিহ্যের দিকে।চাঁদপুরের নামকরণ: ১৭৭৯ খ্রি. ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজ জরিপকারী মেজর জেমস্ রেনেল অতীতের বাংলার যে মানচিত্র এঁকেছিলেন তাতে চাঁদপুর নামে এক অপ্রসিদ্ধ জনপদ ছিল। তখন চাঁদপুরের দক্ষিণে নরসিংহপুর নামক (যা অধুনা নদীগর্ভে বিলীন) স্থানে চাঁদপুরের অফিস-আদালত ছিল। পদ্মা ও মেঘনার সঙ্গমস্থল ছিল সাম্প্রতিক ঠাঁই হতে প্রায় ৬০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে। মেঘনা নদীর ভাঙ্গাগড়ার খেলায় এ অঞ্চল বর্তমানে বিলীন হয়েছে। বার ভূঁইয়াদের আমলে চাঁদপুর এলাকা বিক্রমপুরের জমিদার চাঁদরায়ের দখলে ছিল। এ এলাকায় তিনি ১টি শাসনকেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন। ইতিহাসবিদ জে. এম. সেনগুপ্তের মতে, চাঁদরায়ের নাম অনুযায়ী এ অঞ্চলের নাম হয়েছে চাঁদপুর। অন্যমতে, চাঁদপুর শহরের (কোড়ালিয়া) পুরিন্দপুর মহল্লার ফকিরের নাম অনুসারে এ অঞ্চলের নাম চাঁদপুর। কারো মতে, শাহ আহমেদ নামে একজন প্রশাসক দিল্লী হতে পঞ্চদশ শতকে এখানে এসে একটি নদীবন্দর স্থাপন করেছিলেন। তার নামানুসারে নাম হয়ে গিয়েছে চাঁদপুর। উনি বাস করতেন পুরিন্দপুর এলাকায়। হাজীগঞ্জের ফিরোজশাহী মসজিদ মুসলিম স্থাপত্য কীর্তির সেরা নিদর্শন। যেটি ফখরুদ্দীন মোবারক শাহের দেওয়ান ফিরোজখান লস্কর নির্মাণ করেছেন বলে শিলালিপি থেকে জানা যায়। হাজীগঞ্জ উপজেলাধীন অলিপুর গ্রামে প্রখ্যাত মোঘল শাসক আব্দুল্লাহর প্রশাসনিক সদর কার্যালয় ছিল। এখানে আছে বাদশাহ আলমগীরের নামাঙ্কিত বিখ্যাত আলমগীরি পাঁচ গম্বুজ মসজিদ, শাহাজাদা সুজা স্থাপিত তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ ও মোঘল আমলের বীর সেনানায়কদের শানবাঁধানো মাজার যা আজকাল অলিদের মাজার নামে খ্যাত। ব্রিটিশ আমলে প্রশাসনিক পূর্ণবিন্যাসের ফলে ১৮৭৮ সালে ১ম চাঁদপুর মহকুমার তৈরি হয়। ১৮৯৬ বছরের ১ অক্টোবর চাঁদপুর শহরকে পৌরসভা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৮৪ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি চাঁদপুর জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।বর্তমান চাঁদপুর প্রাচীন বঙ্গে সমতট রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল। খ্রিস্টিয় ৭ম শতাব্দীর দ্বিতীয় পাদের সম্পন্ন দিকে চৈনিক পরিব্রাজক ওয়ান চোয়াঙ সমতট রাজ্যে আগমন করেছিলেন বলে তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্তে পাওয়া যায়। তিনি সমতটকে সাগর তীরবর্তী নিম্ন আদ্র-ভূমি রূপে বর্ণনা করেছেন যা এই এলাকাকে বুঝায়। প্রাচীন বাংলার গায়েব পাল ও সেন রাজবংশের রাজারা এই অঞ্চল শাসন করেছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু এলাকার কোনো স্বতন্ত্র আদি নাম সনাক্ত করা পসিবল হয়নি।
ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ-বিন-বখতিয়ার খিলজী কর্তৃক বঙ্গ জয়ের পর সমগ্র বাংলা মুসলিম শাসনের অধিকারে আসার সঙ্গে সাথে এ অঞ্চলও স্বাভাবিকভাবে মুসলিম শাসনের অন্তর্ভূক্ত হয়। বিশেষ করে সুলতান ফখরুদ্দীন মোবারক শাহ এ এলাকায় শাসন করেছেন এরূপ প্রুফ ইতিহাসে রয়েছে।
জে. এফ. ব্রাইনী সি. এস.-এর মতে রাজা টোডরমল ১৫৮৮ খ্রি. মোগল প্রশাসনের জন্যে ১৯টি বিভাগের প্রবর্তন করেন। এ ১৯টি বিভাগের ভিতরে একটি সেক্টর হলো সোনারগাঁও রাষ্ট্রশাসক বিভাগ এবং এর মধ্যে ত্রিপুরা ও নোয়াখালী অন্তর্ভূক্ত ছিল। ১৭২২ খ্রি. পর্যন্ত টোডরমলের হেতু তার সাথে শাহ সুজা কর্তৃক ১৬৫৮ সালে কানেক্ট ১৩টি চাকলা বা সামরিক অধিক্ষেত্রের একটি ঢাকনা বা জাহাঙ্গীরনগর নামে পরিচিত ছিল। ১৯৬০ খ্রি. পর্যন্ত জেলার নাম ছিল ত্রিপুরা জেলা। তখন এ জেলা ৪টি মহকুমা নিয়ে গঠিত ছিল। তা হলো: সদর উত্তর, সদর দক্ষিণ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চাঁদপুর। তখন ২১টি উপজেলা ও ৩৬২টি ইউনিয়ন কাউন্সিল ছিল। চাঁদপুর মহকুমায় ৫টি উপজেলা ছিল। তা হলো- চাঁদপুর, ফরিদগঞ্জ, হাজীগঞ্জ, কচুয়া ও মতলব।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের টাইম ২৮ মার্চ থেকে ৭ এপ্রিল পর্যন্ত চাঁদপুর শত্রু মুক্ত হতে থাকে। ৭ এপ্রিল সকাল বেলা ৯টায় পাক হানাদার বাহিনী ১ম চাঁদপুরের পুরাণবাজারে আকাশযান হামলা চালায়। চাঁদপুরের বেশ কয়েকটি স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাক হানাদার বাহিনীর সম্মুখ লড়াই হয়। এদের মধ্যে বাবুরহাট, কারিগরি হাইস্কুল, বাখরপুর মজুমদার বাড়ি, ফরিদগঞ্জ-এর গাজীপুর ওটতলী নামক জায়গা অন্যতম। ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর দিবাগত রাত ১০টায় চাঁদপুর সম্পূর্ণরূপে শত্রু মুক্ত হয়। ১৯৮৪ সালে চাঁদপুর মহকুমা হতে জেলায় উন্নীত হয়।
তথ্যগত কোনো ভুল বা অভিযোগ জানাতে মেইল করুন thereversetimer@gmail.com