রাঙামাটি জেলার অজানা ইতিহাস

ভৌগোলিক ভাবে হিমালয় এলাকা হতে দূরে দক্ষিণে শাখা প্রশাখায় প্রসারিত পাহাড়ি অঞ্চল নিয়ে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার অবস্থান। আসাম ও পার্বত্য ত্রিপুরা হতে আরাকান ও বার্মার সীমানা পর্যন্ত। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম জেলা ছিল পার্বত্য ত্রিপুরা তার সাথে আরাকান শাসকদের ১টি বিবাদের বিষয়। আর এইজন্য এ অঞ্চলের রাজ জাতের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট যুজা রূপা (বিরা রাজা) ৫৯০ খ্রিস্টাব্দে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজাকে পরাজিত করেন এবং রাঙ্গামাটিতে তার রাজধানী স্থাপন করেন। আবার ঐতিহ্যগত মতানুসারে, পার্বত্য ত্রিপুরার সম্রাট উদয়গিরি কিলয় ও মংলয় নামের দু’ভাইকে রিয়াং এলাকার অফিসার-ইন-চার্জ নিয়োগ করেন। তারা মাতামুহুরী নদীর দক্ষিণে পাহাড়ি এলাকায় বসবাস করতেন। ৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে আরাকান রাজা সুলা সান্দ্র (Tsula Tsandra) (৯৫১-৯৫৭) বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রাম কর্তৃত্ব করেন। পরবর্তীতে ১২৪০ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরার সম্রাট পুনরায় এ এরিয়া অধিকার করেন।

সুলতানী আমল

সুলতান ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ (১৩৩৮-৪৯) চট্টগ্রাম (সম্ভবতঃ পার্বত্য চট্টগ্রামের অংশসহ) বিজয় করেণ। ১৪০৬ খ্রিস্টাব্দে সুয়াং মংজিৎ আরাকানের সিংহাসন জোর পূর্বক কর্তৃত্ব করেন এবং আরাকান ভূপতি মং সুয়ামন ওরয়ে ন্যারা মিখলা (১৪০৪-৩৪) কে গৌড়ের সুলতান জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ শাহ (১৪১৮-৩১)-এর দরবারে আশ্রয় নিতে আয়ত্ত করেন। ১৪১৮ সালে চাকমা রাজা মউন স্নী বৌদ্ধ মতাদর্শের প্রতি অশ্রদ্ধা জ্ঞাপনের অভিযোগে বার্মার উর্ধাঞ্চল হতে বিতাড়িত হন। উনি অতীতের পার্বত্য চট্টগ্রামের আলীকদম নামক স্থানে মুসলিম অফিসারের অধীনে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং রামু ও টেকনাফে চাকমাদের বসতি স্থাপন করেন। ১৪৩০ খ্রিস্টাব্দে সুলতান জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ শাহের অধীনে ওয়ালী খান নামের একজন মিলিটারী অফিসার চট্টগ্রামে নিয়োজিত থাকা কালে যখন সুয়া মংজিৎকে বিতাড়িত করে মং সুয়ামনকে আরাকানের সিংহাসন পুনরুদ্ধার করে দেওয়ার জন্য নির্দেশিত হন, সেই সময় তিনি গৌড়ের সুলতানের বিপক্ষে রাজদ্রোহী হন। সুলতান জালাল উদ্দিন মুহাম্মদ শাহ্ একদল সৈনিক প্রেরণ করলে তারা ওয়ালী খানকে হত্যা করে এবং আরাকান আক্রমণ করে মগরাজা মং সুয়ামনকে আরাকারে সিংহাসন পুনরুদ্ধারে হেল্প করে।

আরাকানী আধিপত্য

ভূপতি গনেশ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত রাজ বংশের লেটেস্ট ভূপতি সুলতান শামুসদ্দিন আহমেদ শাহ (১৪৩১-৪২) আরাকান সীমানার দূর্গকে এক্সট্রা সৈনিক দিয়ে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে সতর্ক ছিলেন না বলে মং সুয়ামনের উত্তরসুরী মংখারী নামান্তরে আলীখান (১৪৩৪-৩৯) পূর্ববর্তী বছর গুলোতে মুসলিসদের কাছে হারানো রাজ্য পুনঃদখলের জন্য আক্রমণ করেন এবং চাকমাদেরকে রামু ও টেকনাথ হতে বহিষ্কার করতে উপযোগী হন। এ এলাকা বিরোধপূর্ণ থেকে যায় তার সাথে বছর পর্যন্ত আরাকানীদের কর্তৃত্ব মেনে নিতে হয়।

ইলিয়াছ শাহীর আগমন

ইলিয়াছ শাহী সুলতান রুকুনউদ্দিন বারবাক শাহ্ (১৪৫৯-৭৪) তার শাসনের শেষ দিকে সেখানে শাসন ক্ষমতা পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করেন। আলাউদ্দিন হুসাইন শাহ্ (১৪৯৩-১৫১৯) এর শাসন আমলে আরাকানী রাজা স্বল্প সময়ের জন্য তার রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন। ভূপতি মালার উদ্ধৃতি অনুযায়ী ত্রিপুরার রাজার সাথে হুসাইন শাহের তন্ময়তার সুযোগ নিয়েছিলেন আরাকানী রাজা। ইহা ছিল স্পষ্টরূপে আরাকানীদের বিনা উত্তেজনায় আক্রমণ, যা ছিল সম্ভবতঃ যুবরাজ নুসরাতের নেতৃত্বাধীন সেনা অভিযান। তাকে সাহায্য করেন পরাগাল খান, যিনি পরবর্তীতে জয়লাভ করা রাজ্যের মিলিটারী গভর্ণর হয়। পরাগাল তার সাথে তৎপরে তার পুত্র অবসর খান দৃঢ়ভাবে আরাকানীদের দক্ষিণ দিকে তাড়িয়ে দেন। তার সাথে ত্রিপুরার সম্রাটের প্রতি সতর্ক নজর রাখেন। ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগীজ দূত যোয়া ডি সিলভিরো চট্টগ্রামে অবতরণ করেন তার সাথে বন্দরটি ‘‘বাংলার রাজার’’ দখলে দেখতে পান। জয়চন্দ্র (১৪৮২-১৫৩১) নামের একজন বৌদ্ধ ধর্মালম্বী মগ চীফ চক্রশা লাতে বাংলার সুলতানের করদাতা সংখ্যায় কর্ণফুলী ও সাঙ্গু নদীর মধ্যবর্তী এরিয়ায় শাসন ক্ষমতা প্রয়োগ করতেন।

পুনরায় আরাকানী দখল

ত্রিপুরা রাজমালা গ্রন্থ অনুসারে ধন্যা মানিক্য চট্টগ্রাম এলাকায় ত্রিপুরা রাজবংশীয় শাসন ক্ষমতা পুনঃ প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৫১৫ খ্রিস্টাব্দে আরাকান আক্রমণ করেন। তা সত্ত্বেও আরাকানী মগ সম্রাট মিন্যাজা ১৫১৮ খ্রিস্টাব্দে রাজ্যের কিছু অংশ পুনঃ জয় করেন। একই সালের চাকমা চীফ চনু আরাকানী মগ সম্রাটের নিকট বশ্যতা করেন তার সাথে ঐ এলাকায় আরাকানী গভর্ণর হিসেবে নিয়োজিত ধ্যারাং গিরির মাধ্যমে ভূপতির কাছে ২টি চুন রং করা শ্বেতহস্তী উপঢৌকন সংখ্যায় প্রেরণ করেন। আরাকানী রাজা খুশি হয়ে চাকমা রাজাকে ‘‘কুফরু’’ উপাধি প্রদান করেন তার সাথে চাকমা ভূপতির কন্যাকে ১৫২০ খ্রিস্টাব্দে বিয়ে গরেন। পরবর্তীতে ত্রিপুরার দেবমানিক্য আরাকানীদের হাত থেকে রাজ্যের কিছু অংশ ১৫২২ খ্রিস্টাব্দে অস্থায়ী ভাবে নিয়ে যান। অথচ আরাকানের মিবিন ওরফে যাবুক শাহ (১৫৩১-৫৩) পুনরায় ১৫৩১ খ্রিস্টাব্দে রাজ্যের অধিকার গ্রহণ করেন।

শেরশাহের শাসন

শেরশাহের যুদ্ধের টাইম চট্টগ্রাম বন্দরটি হয়ে ওঠে পর্তূগীজ সৈন্যদের মিলনস্থল (ঘাঁটি)। শেরশাহের ডেপুটি ঐ ঠাঁই দখল করেন। অথচ উনি নিজেই চট্টগ্রামস্থ পর্তূগীজ কলোনীর সর্বশ্রেষ্ঠ নুন ফারনান্ডিজ ফ্রাইর কর্তৃক যুদ্ধবন্দী হয়ে যান। অবশ্য সম্পন্ন পর্যন্ত এ এরিয়ায় শেরশাহের শাসন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়।

ত্রিপুরার বিজয় মাণিক্য

ষোড়শ শতাব্দীতে বাংলার ইতিহাসে ত্রিপুরার রাজাগণ উল্লেখযোগ্য জায়গা করে নেন। ‘‘আইন-ই-আকবরী’’ তে উক্ত মতে, বিজয় মাণিক্য (১৫৪০-৭১) ছিলেন একজন ক্ষমতাশালী শাসক। তিনি মুসলিমদের নিকট হতে চট্টগ্রাম অঞ্চলকে পুনঃলাভ করেন। যদিও সিকান্দার শাহ্ ত্রিপুরা আক্রমণ করেন এবং রাজধানী লুন্ঠন করেন। অমরমানিক্য (১৫৭৭-৮৬) আরাকানী সম্রাট সিকান্দার শাহের নিকট দীন ভাবে পরাজয় বরণ করেন।

আরাকানীদের অভিযান

ধারণা করা হয় যে, আরাকানী রাজা পুনরায় ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে এ জেলা আক্রমণ করেন। রাফ ফিচ ১৫৮৫ সালে লিখেছেন যে, এ জেলাটি ছিল আরাকানী রাজাদের অধীনে যারা ত্রিপুরার রাজাদের সঙ্গে এর দখল নিয়ে অবিরত যুদ্ধে মগ্ন থাকতেন।দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার বৃহৎ ভাগে নবাব আকবরের শাসন ক্ষমতা প্রসারণের জন্য তার নাম মাত্র বঙ্গ জয়ের অব্যবহিত পরে এ অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ অরাজনৈতিক কঠোর অবস্থার সুযোগ নেয় আরাকানের রাজা (বাহারীস্থানে জানানো হয়রাখাং)। আরাকানের সম্রাট মং ফালং সম্পূর্ণ চট্টগ্রাম এরিয়াকে তার কর্তৃত্বে নিয়ে আসেন তার সাথে নোয়াখালী ও ত্রিপুরার বৃহৎ অংশ কর্তৃত্ব করে নেন। তার পুত্র মংখামন কয়েকবার বাংলায় সামরিক অভিযান চালায় তার সাথে মোগলদের জন্য সে ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আরাকানী ভূপতি সচরাচর এক ভাই কিংবা ২য় পুত্রকে এ জেলায় অফিসার-ইন-চার্জ নিয়োগ করতেন। ১৬০১ খ্রিষ্টাব্দে মং রাজাগ্নি আরবী, বার্মিজ ও দেবনাগরী তিনটি ভাষায় মুসলিম ও বার্মিজ পদবীসহ মুদ্রার প্রচলন করেন।পর্তূগীজ জলদস্যু

পর্তূগীজ সমুদ্র দস্যুরা (যাদেরকে সাধারণতঃ ফিরিঙ্গি জলদস্যু বলা হয়) আরাকানী সম্রাটের অধিকৃত এলাকায় ২টি শক্তিশালী উপনিবেশ স্থাপন করলেও (১টি চট্টগ্রাম শহরের ২০ মাইল দক্ষিণে দিয়াংগাতে এবং অপরটি আরাকান উপকূলের সিরিয়ামে তারা পুরোপুরি ভাবে আরাকান ভূপতির নিকট আত্মসমর্পণ করেনি। জবাব পশ্চিমে বঙ্গদেশ এবং দক্ষিণে আরাকান রাজ্যের মাঝামাঝি এরিয়ায় চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলটির অবস্থান হওয়ায় ফিরিঙ্গি জলদস্যুদের চট্টগ্রামে একটি শক্তিশালী দূর্গ ছিল এবং এখান থেকে তারা দক্ষিণ ও পূর্ব বাংলার উপকূলীয় এলাকায় লুঠতরাজের জন্য অবিরত হানা দিত। দিয়াংগা ও সিরিয়ামের ফিরিঙ্গি জলদস্যুরা প্রায়শঃ তাদের রাজনৈতিক অধিস্বামী আরাকানী রাজার সঙ্গে ঝগড়ায় লিপ্ত হতো।

মগদের অত্যাচার

পর্তূগীজ লুন্ঠনকারীরা চট্টগ্রাম এলাকায় স্থানীয় মগদের অতল সহায়তায় বঙ্গদেশে লুঠতরাজ কাজ পরিচালনা করতো। এই মগরা ছিল সমভাবে দক্ষতাসম্পন্ন নাবিক, নিষ্ঠুর ও দুঃসাহসী জাতি এবং তারা অনুরূপ দস্যুবৃত্তি করেই জীবিকা নির্বাহ করতো। Fathiya এর কবি তার সাথে ইউরোপীয় পরিব্রাজক Bernier এর লেখায় এজাহার বহন করে যে, এই আধাসভ্য মঙ্গোলীয় যাযাবরদের অদ্ভূত মুখাবয়ব, রীতি ও প্রথার জন্য তার সাথে তারা পুনঃ পুনঃ নির্মম আক্রমণ করে জনগণের গুরুতর ক্ষতি সাধন ও নিদারুণ দুঃখ পরিশ্রমের সৃষ্টি করতো বিধায় তাদেরকে ঘৃণার পাত্রবলে মোগল অফিসার ও বাংলার লোকেরা চিহ্নিত করেন।

মোগল আমল

১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এ এলাকা আরাকানীদের দখলে ছিল। ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে নবাব আওরঙ্গজেব আলমগীরের অধীনে বাংলার গভর্ণর জব্দ খান আরাকান দরবার ও পর্তুগীজদের মাঝে দ্বন্দের সুযোগ নিয়ে এ অঞ্চল জয়লাভ করেন এবং ধর্ম প্রাণ ভূপতির নির্দেশে চাঁটগার নাম সংস্কার করে ইসলামাবাদ রাখেন। ১৭১৫ খ্রিস্টাব্দে জালাল খাঁ ভূপতি হওয়ার সমতল বাসীদের সঙ্গে পার্বত্য বাসীদের বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামের মোগল প্রশাসককে ১১ মণ কার্পাস তুলা দেওয়ার জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। কিন্তু মোগল প্রশাসকগণ পার্বত্য অঞ্চলকে তাদের নিজেদের অধীনস্থ অঞ্চল হিসেবে ‘‘কার্পাস মহল’’ নাম দিয়ে কর আদায় করতে চাইলে চাকমা রাজা কর দেওয়ার জন্য অস্বীকার করেন এবং উনি ১৭২৪ খ্রিস্টাব্দে আরাকানে চলে যান। কিন্তু মোগল প্রশাসককে ১৭২৪ থেকে ১৭৩৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ফতে খাঁ ১১ মণ কার্পাস কর দেন। ১৭৩৭ খ্রিস্টাব্দে শেরমুস্ত খাঁ কার্পাস কর দেয়ার শর্তে কোদালা, শীলক, রাঙ্গুনিয়া অঞ্চলে জমিদারী লাভ করেন। রাণী কালিন্দির মতে, ভূপতি শেরমুস্ত খাঁর পর শুকদেব রায়, তারপর শের দৌলত খাঁ, পরেজানবক্স খাঁ, আর্য্যপুত্র ধরমবক্স খাঁ এবং পরে কালিন্দি রাণী নিজে ছিলেন চাকমা রাজার দায়িত্বে। ১৭৫৮ খ্রিস্টাব্দে রাজা শেরমুস্ত খাঁ মরণ বরণ করেন। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে মোগল সাম্রাজ্যের অধীনে অর্ধ স্বাধীন সম্রাট মীরকাশীম আলী খান কর্তৃক ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর নিকট সমর্পিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত চট্টগ্রাম জেলা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম মোগলদের দখলে নিরাপদে ছিল।

ইষ্ট ভারত কোম্পানী

১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম এরিয়া ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কাছে সমর্পিত হওয়ারপরে ১ম কয়েক বছর সম্ভবতঃ সমর্পিত অঞ্চলের ঐ অংশের ঐ অংশের প্রশাসনের উপরই কর্তৃপক্ষের বহু মনযোগ নিবিষ্ট ছিল, যে অংশটি পরবর্তীকালে রেগুলেশান জেলা পরিমাণে (চট্টগ্রাম) গঠিত হয়। পার্বত্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী হেডম্যানদের দখল তখনও বহাল রাখা হয় এবং বাস্তববিক পক্ষে রাষ্ট্রের অধিক্ষেত্রে কেবলমাত্র তুলা চাষের ওপর কর সংখ্যায় খাজনা আদায়ের কাজই প্রসারিত হয়। এই রাজস্বও পাহাড়ি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের নিকট থেকে সরকারি অফিসার দ্বারা করা হতো না। বরং এমন এক তৃতীয় পক্ষ দ্বারা আদায় করা হতো যিনি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের কর্মচারী শাসকও ছিলেন না কিংবা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী মেম্বারদের উপরও কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। যেমন- রাজা জালাল খাঁর টাইম বিনোদ চৌধুরী, শেরমুস্ত খাঁ ও শের জববার খাঁ সময় রামচৌধুরী, শের দৌলত খাঁর সময় রামতনু সেন কার্পাস কর আদায়ের জন্য ঠিকাদারনিযুক্ত ছিলেন।

ইংরেজদের বিরুদ্ধাচরণ

১৭৭৬ খ্রিষ্টাব্দে রাজা শের দৌলত খাঁ ইংরেজদের কর প্রদান বন্ধ করে দেন। ১৭৮২খ্রিষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর পর পুত্র জানবক্স খাঁ বহু শক্তি নিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধাচরণ করেন। তিনি পার্বত্য এরিয়া হতে গাছ, বাঁশ, শন, বেত ইত্যাদি বন সম্পদ সংগ্রহ করা ও পার্বত্য এলাকা সংলগ্ন জমিতে সমতল বাসীদের চাষ করা নিষিদ্ধ করে দেন। অপরদিকে ইংরেজগণও পার্বত্য অঞ্চলে শুটকী, তামাক, লবণ, চিটাগুড় প্রভৃতি প্রেরণ অফ করেন দেন। এরপর রাজা জানবক্স খাঁকে দমন করার জন্য মেজর অঞ্চলকে (Ellerkar) প্রেরণ করা হয়। তখন ভূপতি জানবক্স খাঁ কলকাতায় গিয়ে লেঃ গভর্ণরের নিকট আত্মসমর্পণ করেন। জানবক্স খাঁ ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। পরবর্তীকালে আর কোন ভূপতি ইংরেজদের বিরুদ্ধাচরণ করেনি।

রোনা খানের বিদ্রোহ

১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামস্থ কোম্পানীর অতুলনীয় গভর্ণর জেনালের ওয়ারেন হেস্টিংসকে এপ্রিল মাসে লিখে জানায় যে, এক পর্বতবাসী রোনা খান কোম্পানীর জমিদারদের উপর বিভিন্ন রকম ট্যাক্স বল পূর্বক সংগ্রহ করে এবং কিছু দাবী তুলে উৎপীড়ন করছে। রোনা খান তাকে সাহায্য করার জন্য কুকীদের একটা বড় দলকে সঙ্গে নেন। তারা পাহাড়ের অভ্যন্তরে দূরে বসবাস করতো এবং কোন আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করতো না। তারা দেহ সম্পূর্ণ অনাবৃত থাকতো। ইষ্ট ভারত কোম্পানি কর্তৃক এই বিদ্রোহ দমনকরা হয়। এ বিদ্রোহ দমন করার জন্য গিয়ে পাহাড়ি লোকদেরকেও চট্টগ্রামের প্রতিবেশী জেলার হাটবাজারে অ্যাক্সেস অফ করে দেয়া হয়। কিন্তু কুকীরা তারপরও অবিরত বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতো। ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দ নভেম্বর মাসে চট্টগ্রামস্থ এজেন্সি প্রধান ২২তম ব্যাটালিয়ানের কমান্ডিং কর্মকর্তা অধিনায়ক (পরে মেজর) এলাকার (Ellerker) কে কিছু সৈনিক পাঠিয়ে বাসিন্দাদের রক্ষা করার জন্য নির্দেশ দেন। ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে গভর্ণর চট্টগ্রামের চীফকে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেন যে, পাহাড়ি লোকদেরকে নিম্নাঞ্চলে চাষাবাদের চান্স দিয়ে মান্তিকামী প্রজা হিসেবে বসবাসের আয়োজন করে নিবৃত্ত করা যায় কিনা? অথচ এ প্রস্তাবে আসলে কোন সুফল পাওয়া যায়নি।

আরাকানী উপজাতির আগমন

১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দের ২৪ জুন তারিখে আরাকানী রাজা কর্তৃক চট্টগ্রামের চীফের প্রতি লেখা ১টি চিঠি থেকে কিছু ইতিহাসজ্ঞ তথ্য জানা যায়। আরাকান হতে পালিয়ে আসা কিছু ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নাম সম্রাট উল্লেখ করেছিলেন, যারা চট্টগ্রামের পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছিল এবং উভয় রাষ্ট্রের জনগণের উপরই নির্যাতন করতো। এই চিঠিতে পার্বত্য এলাকায় অধুনা বসবাসরত অন্ততঃ চারটি উজাতির নাম উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন- মগ, চাকমা, ম্যারিং বা মুরং এবং লাইস (পাংখু তার সাথে বনযোগী)। আরাকানী রাজা চেয়েছিলেন যে, এ সকল দস্যুদেরকে পার্বত্য এরলাকা থেকে বিতাড়িত করা কর্তব্য যাতে ‘‘আমাদের ফ্রেন্ডশিপ নিষ্কলঙ্ক থাকে এবং পর্যটকদের ও ব্যবসায়ীদের জন্য পথ নিরাপদ থাকে।’’উপজাতিরা বৃটিশ প্রজা নয়, কেবল করদাতা

১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে মিঃ হ্যালহেড (Mr. Halhad) কমিশনার স্বীকৃতি দেন যে, পাহাড়ি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা বৃটিশ প্রজা নয়, তবে কেবলমাত্র করদাতা। উনি করেন যে, তাদের অভ্যন্তরীণ আয়োজনে বৃটিশদের হস্তক্ষেপ করার কর্তৃত্ব নেই। এইজন্য ১টি শক্তিশালী ও স্থায়ী সরকারের নিকট প্রতিবেশের সুবাদে উপজাতীয় চীফগণ স্তরে স্তরে বৃটিশ প্রভাবের অধীনে আসে তার সাথে অষ্টাদশ শতাব্দীর সম্পন্ন দিকে প্রত্যেক নেতৃস্থানীয় চীফগণ চট্টগ্রাম কালেক্টরকে সুনির্দিষ্ট কর দেওয়ার জন্য কিংবা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী বাসিন্দা ও সমতলের মানুষের মধ্যে মুক্ত বিজনেসের (Free Trade) সুযোগ নেয়ার জন্য বার্ষিক উপহার দিত। ১ম দিকে ইহার হিসাব ক্ষতি বৃদ্ধি হয়।কিন্তু ধীরে ধীরে তা বিশেষ ও নির্দিষ্ট হারে ধার্য হয়। পরিশেষে তা কর হিসেবে না হয়ে ভূমিকর হিসেবেই রাষ্ট্রকে প্রদানের জন্য নির্ধারিত হয়। রাষ্ট্রশাসক বিভাগ তারপরও পার্বত্য অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ করতো না। উল্লেখ্য, চাকমা রাজাগণের ভিতরে খাঁ উপাধির সম্পন্ন সম্রাট ছিলে ধরমবক্সখাঁ। ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে ভূপতি ধরমবক্স খাঁর মরণ হলে রাণী কালিন্দি রাজ কার্য পরিচালনার দায়িত্ব হাতে নেন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা সৃষ্টি

রাষ্ট্রের মধ্যে বসবাসরত পাহাড়ি যে সকল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের নিয়ে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম গঠিত হয়েছে, তারা ছিল পূর্বদিকের অধিকতর সরে অত্যাচারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের জন্য অবিরত হামলার টার্গেট বস্তু। কাপ্তাই খালের পাড়ে অবস্থিত একটি দূর্গের ওপর আক্রমণের পরিণতিতে ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে বিভাগীয় কমিশনার পাহাড়ি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের জন্য একজন সুপারিনটেনডেন্ট নিযুক্ত করে পার্বত্য এলাকাকে রেগুলেশান জেলা চট্টগ্রাম হতে পৃথক করার সুপারিশ করেন। এই উভয় সুপারিশই স্বীকৃত হয় এবং ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের ACT XXII দ্বারা ঐ বর্ষের ১লা আগস্ট তারিখে তা কার্যকর হয়। পার্বত্য এরিয়াকে রেগুলেশন জেলা চট্টগ্রাম হতে পৃথক করা হয় এবং একজন অফিসারকে পার্বত্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের জন্য সুপারিনটেনডেন্ট পদে নিয়োজিত করা হয়। এভাবেই রেগুলেশান জেলার সিভিল, ক্রিমিনাল তার সাথে খাজনা আদালত ও অফিসারদের অধিক্ষেত্র থেকে পাহাড়ি ও বনাঞ্চলকে আলাদা করা হয়। একজন Hill Superintendent নিয়োগের প্রাথমিক টার্গেট ছিল তার অধিক্ষেত্রের মধ্যে অত্যাচারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের প্রতিরোধ করা তার সাথে নিরীহ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের রক্ষা করা। তার অধস্তন পাহাড়ি এলাকাকে তখন হতে পার্বত্য চট্টগ্রাম নামে অভিহিত করা হয় (তার পূর্ব পর্যন্ত কার্পাসমহল জানানো হত) এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার সদর অফিস চন্দ্রঘোনাতে স্থাপিত হয়। পরবর্তী কয়েক সালের জন্য সীমান্তের আরাম রাক্ষার প্রতি বিশেষ মনযোগ দেয়া হয়। এ সময়ে রাণী কালিন্দি চাকমা সম্রাটের দায়িত্বে ছিলেন। ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার অফিসার ইন চার্জ এর পদবী সুপারিনটেনডেন্ট হতে পরিবর্তন করে জেলা প্রশাসক (Deputy Commissioner) করা হয় তার সাথে গোটা পার্বত্য অঞ্চলের ভূমিকর ও বিচার ব্যবস্থার যাবতীয় বিষয়েতাকে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা প্রদান করা হয়। সেইম সময়ে জেলাকে যথোপযুক্ত ভাগকরে মহকুমায় ভিক্ত করা হয় তার সাথে সেগুলোতে অধস্তন কর্মকর্তাও নিয়োগ করা হয়। ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসের মধ্যে চন্দ্রঘোনা থেকে রাঙ্গামাটিতে জেলা সদর কার্যালয় স্থানান্তর করা হয়।কুকী ও আদার্স উপজাতিদের আক্রমণ

বৃটিশশাসন কালে কুকীদের দ্বারা ১৮৫৯, ১৮৬৬, ১৮৬৯, ১৮৮৮ ও ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে লুন্ঠনের প্রুফ পাওয়া যায়। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বৃটিশ গভর্নমেন্ট পাহাড়ি অঞ্চলে ইন্টারনাল অর্থনীতির বিষয়ে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ করেনি। ঐ বছর অত্যাচারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা, জাতিগত ভাবে যাদেরকে কুকী বলা হয়, আসন্ন তিপ্পেরা (Tipperah) জেলার বৃটিশ প্রজাদের ওপর প্রকাশ্য উপদ্রব করে হত্যাযজ্ঞ চালায়। এ আক্রমণের ঘটনা এতই বড় ধরণের ছিল যে, সরকারের জন্য ইহা খুবই উদ্বিগ্নের রিজন হয়ে দাঁড়ায়। এ ঘটনার ফলেই পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা প্রস্তুত তরান্বিত হয়। তিপ্পেরা জেলায় কুকীদের আক্রমণের ১৮৬ জন বৃটিশ প্রজা খুন হয় এবং ১০০ জনকে বন্দী করা হয়। পার্বত্য অঞ্চলের উত্তর-পূর্ব অংশে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা আক্রমণ ও বন্দিদশার ঘটনা স্পষ্টরূপেই হৃদয়ঙ্গম করে এবং সে অনুসারে ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারী মাসে অপরাধীদের শাস্তি প্রদানের জন্য বরকলে ১টি সেনা সমাবেশ ঘটানো হয়। লুসাই চীফ রতনপুয়া গ্রামটি বরকলের উত্তর-পূর্বে ১৮মাইল সরে অবস্থিত ছিল। ২৭ জানুয়ারী তারিখে ক্যাপ্টেন (পরে মেজর) র‌্যাবনের নেতৃত্বে পাতলা অস্ত্রশস্ত্রসহ ২৩০ জন সিলেক্টেড সিপাই ও ৪৫০ জন কুলীর সাহায্যে খাবার দ্রব্যাদি বহন করে বরকল থেকে রতনপুয়ার গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। ঐ গ্রামে প্রবেশ করাই কঠিন ছিল। পরিশেষে ঐ সৈন্যদল ৬দিন পর্যন্ত হেঁটে অসংখ্য পাহাড়, তটিনী ও কাঁটাময় ঝোপ জঙ্গল পার করে ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ১ ফেব্রুয়ারি তারিখে ঐ গ্রামে পৌঁছে। কুকীরা যাবতীয় মূল্যবান সরিয়ে নিয়ে গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং গ্রাম থেকে সরে গিয়ে ওৎপেতে থেকে সৈন্যদের প্রতি সহসা আক্রমণের পথ বেছে নেয়। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী লোকদের ক্রাইমের জন্য শাস্তিস্বরূপ মাত্র ১৫০০ মন চাউল অনলে ধ্বংস হয়- এ টুকই যা ক্ষতি। এ অভিযানে এতটুকুই সাধ্য ছিল, যা সম্পাদন শেষে সৈন্যদেরকে বরকলে ফেরত আসতে হয়। এরপর সন্ধি স্থাপনের জন্য আলোচনা চলে তার সাথে ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে রতনপুয়া আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেয়। পরের ২ বছর অর্থাৎ ১৮৬২ ও ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত পার্বত্য এরিয়ায় স্বাচ্ছন্দ বিরাজ করে। তবুও ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে ১৫ ও ১৯ জানুয়ারীতে একদল সেন্দু ২টি গ্রাম আক্রমণ করে ৫ জনকে হত্যা করে এবং মহিলা ও শিশুসহ ২৩ জনকে ভৃত্য হিসেবে নিয়ে যায়। সেইম সালের এপ্রিল মাসে সেইম ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর দুস্কৃতিকারীরা ২৬ জনের ১টি বাঙালী কাঠুরিয়া দলকে আক্রমণ করে ৫ জনকে গুলি করে তার সাথে ৯ জনকে আটক করে। অতঃপর তারা একটি খিয়াংথা গ্রামে আক্রমণ করে তার সাথে ৫৬ জন অধিবাসীর মধ্যে ৬ জনকে হত্যা করেও ৩০ জনকে বন্দী করে নিয়ে যায়। ১৮৬৫-৬৬ সনে সেন্দুরা পার্বত্য এলাকায় আরো ২টি হামলা করে। প্রথম বারে ৬ জনকে এবং দ্বিতীয় বারের ২০ জনেরও অধিক ব্যক্তিকে বন্দী করে নিয়ে যায়। ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে লুসাই এর হলং জাতি আরো গুরুতর সামনে উপদ্রব চালায়। এ জুলুম চালায ৬ই জুলাই। সেই সময় তারা বনযোগী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের ৩টি গ্রামের ক্ষতি হয়। তাদের সবাইকে পার্বত্য অঞ্চলের দক্ষিণে উপত্যকায় বোমাং কুকী বলা হতো। তাদেরই একটি বিচ্ছিন্ন টিম বৃটিশ রাজ্যের কর্ণফুলী নদীর শাখা কাপ্তাই খালে ঢুকে পড়ে তার সাথে ওই জায়গা একটি গ্রাম বিনাশ করে। তারা ৮০ জনকে বন্দী হিসেবে নিয়ে যায় তার সাথে ৪ জনকে হত্যা করে। এ আক্রমণটি উল্লেণখযোগ্য ছিল, কারণ সেই সময় ঘটনাটি ঘটে বর্ষা মৌসুমে, যখন কুকীরা সাধারণতঃ কৃষিকাজে ব্যস্ত থাকতো এবং প্রতিকূল মৌসুমে ও অনতিক্রম্য বাঁধার কারণে অভিযান চালানো ছিল। ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দের ১২ জানুয়ারিতে হলং জাতি পুনরায় বোমাং অঞ্চলেরকিয়াংথা (মগ) গ্রামে হানা দিয়ে ১১ জনকে হত্যা ও ৩৫ জনকে দাসত্বের জন্য নিয়ে যায়। ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে কোন হামলা হয়নি। অথচ ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে সাঙ্গু নদীর ওপর চিমা পুলিশ ফাঁড়িতে ১টি হামলা হয় তার সাথে ১০ জনের গার্ড পরাজিত হয় ও ফাঁড়িটি ধ্বংস হয়। ৭ জন নিহত হয় এবং সমস্ত গার্ডের মেয়ে ও শিশুদের বন্দী হিসেবে নিয়ে যায়। পরের মাসের মধ্যেই পুলিশ ফাঁড়িটি পুনঃনির্মিত হওয়ার পর সেখান থেকে আধা ঘন্টার হাঁটা রাস্তা সরে অধিষ্ঠিত ১টি গ্রামে ১৮৭০ সনের ১৯শে জুলাই সকালে ৪০/৫০ জনের ১টি দল পুনরায় আক্রমণ করে তার সাথে ৪ লোক ও৬ শিশুকে আটক করে নিয়ে যায়। আবার চিমা ও পিন্দুর মাঝামাঝি স্থানে সাঙ্গু নদীর পাড়ে একটি গ্রামে একই বর্ষের ডিসেম্বর মাসে আরো একটি আক্রমণ সংঘটিত হয়। এতে ২ জন নিহত তার সাথে ১ জন বন্দী হয়। ১৮৭১ সনে কোন হামলা হয়নি। অথচ ১৮৭২সনের জানুয়ারীতে ১টি সেন্দু দল পিন্দু সীমানা পুলিশ ফাঁড়িতে আকস্মিক হামলা চালায়। এ অসম সাহসিক কর্মটি অনুষ্ঠিত হয়ে গিয়ে ছিল সুসংহত ভাবেই। তবে হামলাকারীদের কয়েকজন প্রবেশ পথেই প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় তার সাথে তাদেরকে শীঘ্রই ১৮৭০-৭১ সনে লুসাই এর হলং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা কেচার (Cacher) এর প্রতিবেশী বৃটিশ জেলায় বেশ কতিপয় বার অস্বাভাবিক উত্যক্ত হবার মতো আক্রমণ অনুষ্ঠিত করে, যাতে কতিপয় জন ইউরোপীয়কে জীবন বিসর্জন দেওয়ার জন্য হয়। এছাড়াও একজন রোপনকারীর কন্যাসহ স্থানীয় কয়েকজন বৃটিশ প্রজাকে আক্রমণকারীরা বন্দী করে নিয়ে যায়। এ সকল জুলুম জুলিমের ঘটনা তৎকালীন সরকারকে কার্যকর প্রতিশোধমূলক স্টেপ নিতে কঠিন প্রতিজ্ঞ করে এবং লুসাই অঞ্চলে সেইম সাথে ২টি প্রতি আক্রমণ পরিচালিত হয়। ১টি কেচার থেকে জেনারেল বাউচারের নেতৃত্বে এবং অপরটি পার্বত্য চট্টগ্রাম এরিয়া হতে জেনালের ব্রাউনলো, সি.বি. এর নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। এ যুদ্ধাভিযান পাঁচ মাসব্যাপী চলে এবং সম্পূর্ণরূপে সাকসেস হয়। লড়াই বন্দীরা পুনরুদ্ধার হয় তার সাথে অপরাধী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা আত্মসমর্পণ করে। তাদের সবাইকে বেআইনী ও কারণ ছাড়া আক্রমণের জন্য বহু পরিমাণ জরিমানা দেওয়ার জন্য আয়ত্ত করা হয়। তৎপরে আর কোন গোলোযোগ সংঘটিত হয়নি। যদিও ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে বর্ষা চালু হওয়ার অল্প পূর্বে সেন্দুদের দত্বারা একটি প্রচেষ্টা নেয়া হয়, তবুও আক্রমণের সম্ভাব্য গ্রামটি তাদের মোকাবেলা করার জন্য রেডি ছিল বলে তারা দ্রুত পশ্চাদ পসরণ করে। সেন্দু জাতি ও অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা মহৎ ভূমিকে অধিকারে রেখে জেলার দক্ষিণাংশে আক্রমণ করার জন্য আড়াল (প্রতিবন্ধক) হিসেবে ব্যবহার করতো। কুকীরা এবং অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা মাঝে মাঝে আক্রমণ অব্যাহত রেখে বিপুল বিনাশ যজ্ঞ চালাতো। ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে উজাতিদের বিরুদ্ধে একটি চূড়ান্ত সেনা অভিযান পরিচালিত হয় তার সাথে অতঃপর হতে এ অঞ্চলে সম্পূর্ণরূপে শান্ত হয়।

জেলায় মর্যাদা অপব্যয় বৃদ্ধি ও রেগুলেশান জারী

ইতো পূর্বে ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে বৃটিশ কর্তৃক লুসাই পাহাড় কর্তৃত্ব হওয়ার পরে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার গুরুত্ব অনেকটা অপব্যয় পায় তার সাথে এর গুরুত্ব কমিয়ে মহকুমা করা হয়। তখন জেলাটি বিভাগীয় কমিশনারের আয়ত্ত একজন সহকারী কমিশনারের দায়িত্বে দেয়া হয় (উল্লেখ্য, ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে রাণী কালিন্দির মরণ হলে হরিশ রায় রাজা হন। হরিশ চাঁদ ছিলেন ধরমবক্সের ৩য় রাণী হারিবীর কন্যা মেনকার সন্তান। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে রাজা হরিশ চন্দ্রের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ভূবন মোহন রায় রাজা হন। ১৯০০ সনের ১নং রেগুলেশান অনুসারে অঞ্চলটি পুনরায় জেলায় উন্নীত করা হয় তার সাথে অফিসার-ইন-চার্জ এর পুরাতন পদবী সুপারিনটেনডেন্ট প্রত্যার্পণ করা হয়। জেলার সীমান্ত পাল্টানো করে দেমাগিরির ১৫০০ জনের বসতিসহ পূর্বাংশের একটা লম্বা অংশ লুসাই জেলায় স্থানান্তর করা হয়। জেলাটি সেইম টাইমে চাকমা, মং ও বোমাং সার্কেলের বিভিন্ন অংশে বিভক্ত করা হয় এবং স্ব স্ব সার্কেল চীফদের কাছে বিন্যস্ত করা হয়। সার্কেল চীফকে খাজনা আদায়ের তার সাথে নিজ নিজ এলাকার অভ্যন্তরীণ ব্যপারে নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। চাকমা সার্কেলের অধীনে থাকে জেলার মাঝামাঝি ও উত্তরাঞ্চল, বোমাং সার্কেলের অধীনে দক্ষিণাংশ এবং মং সার্কেলের অধীনে থাকে উত্তর-পশ্চিমাংশ। এ সার্কেলগুলো অনুরূপ অংশ নিয়ে ৩টি মহকুমা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও রামগড় স্থাপন করে মহকুমা প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হয় তার সাথে তাদের সবাইকে সার্কেল চীফের কার্যাবলী তদারকী ও লিঁয়াজো করার দায়িত্ব দেয়া হয়।

রেগুলেশান সংশোধন

১৯০০ বর্ষের রেগুলেশানটি পার্বত্য চট্টগ্রাম (সংশোধন) রেগুলেশান, ১৯২০ দ্বারা সংশোধিত হয় এবং সুপারিনটেনডেন্ট পদটি পাল্টানো করে জেলা প্রশাসক ও এসিসট্যান্ট সুপারিনটেনডেন্ট পদটিকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর করা হয়। দ্বৈত শাসনের প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘‘শাসন বহির্ভূত অঞ্চল” পরিমাণে নির্বাহী পরিষদের সহায়তায় গভর্ণরের এক চেটিয়া দায়িত্বে সংরক্ষিত রাখা হয়। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ভূপতি ভূবন মোহন রায়ের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র নলিনাক্ষ রায় ভূপতি হন। চাকমা রাজাদের মধ্যে তিনিই ১ম গ্রাজুয়েশন ডিগ্রিধারী ছিলেন।

পাকিস্তান আমল

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলাটি বৃটিশ শাসনের আয়ত্ত হতে পাকিস্তানের অধিক্ষেত্রে আসে তার সাথে পর্যাপ্ত পরিবর্তন ও উন্নয়নের আওতায় আনা হয়। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট নলিনাক্ষ রায়ের মরণ হলে তাঁর পুত্র ত্রিদিবরায় চাকমা সম্রাট হন। তিনি পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের মেম্বার ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের টাইম তিনি পাকিস্তানের সাপোর্ট করে ওই জায়গা অবস্থান করেন। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে কর্ণফুলীতে নদীতে কাপ্তাই বাঁধ প্রস্তুত করা হলে পার্বত্য রাঙ্গামাটির ভৌগলিক ও আর্থ-সামাজিক সিচুয়েশনে বিপুল পরিবর্তন আসে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, কাপ্তাই বাঁধের কারণে ১,০০,০০০ অধিবাসী ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং পাহাড়ি বাসিন্দাদের ভিতরে অসন্তোষের কারণ গুলোর মধ্যে তা ছিল অন্যতম।

বাংলাদেশের অভ্যুদয়

১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত ভূপতি ত্রিদিব রায়ের জ্যেষ্ঠপুত্র দেবাশীষ রায় অপ্রাপ্ত বয়স্ক থাকায় ত্রিদিবরায়ের ভাই কুমার সমিত রায় রাজকার্য পরিচালনা করেন। ১৯৭৮খ্রিস্টাব্দ থেকে দেবাশীষ রায় চাকমা ভূপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দের ১০ সেপ্টেম্বর তারিখে নিউ মহকুমা খাগড়াছড়ি, লামা ও কাপ্তাই গঠন করার জন্য পুরাতন মহকুমা গুলোও পুনর্গঠন করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে বান্দরবান ও লামা মহকুমা নিয়ে নতুন জেলা বান্দরবান গঠিত হয়। পরে ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে জেনালের এরশাদ সরকারের টাইমে সারাদেশে প্রশাসনিক পাল্টানোর পদ্ধতিতে খাগড়াছড়ি ও রামগড় মহকুমা নিয়ে খাগড়াছড়ি জেলা তৈরি করা হয়। আরো পরে ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দের ২৫ ফেব্রুয়ারী রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা, বান্দরবান পার্বত্য জেলা ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার আলাদা নামকরণ ও সীমানা নির্ধারিত হয়। সম্প্রতি রাঙ্গামাটি জেলার বৃহত্তর অংশ ও খাগড়াছড়ি জেলার কিছু অংশ নিয়ে চাকমা সার্কেল, খাগড়াছড়ি জেলার বৃহত্তর অংশ নিয়ে মং সার্কেল এবং বান্দরবান জেলার বৃহত্তর অংশ রাঙ্গামাটি জেলার কিয়দংশ নিয়ে বোমাং সার্কেল রয়েছে।

জেনারেল এরশাদের শাসনকালে ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে তিন পার্বত্য জেলায় স্থানীয় গভর্নমেন্ট পরিষদ আকৃতি করে পরিষদ গুলোকে প্রচুর ক্ষমতা প্রদান করা হয়। স্থানীয় পরিষদের চেয়ারম্যান পদটিকে উপমন্ত্রীর পদমর্যাদা সমাপ্ত করা হয়। ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে আরাম চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় পরিষদের নামকরণ পরিবর্তিত হয়ে পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং আরও অধিক ক্ষমতা প্রদান করা হয়। চুক্তির পরে তিন পার্বত্য জেলা নিয়ে একটি আঞ্চলিক পরিষদও গঠিত হয়। আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা সম্পন্ন। আঞ্চলিক পরিষদের সদর কার্যালয় রাঙ্গামাটি শহরে অবস্থিত। সুতরাং রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় এক জটিল ও বিশেষ ধরণের প্রশাসনিক কাঠামো কার্যকর।

তথ্যগত কোনো ভুল বা অভিযোগ জানাতে মেইল করুন thereversetimer@gmail.com

#naming#history#Bangladesh#bangla#thereversetimes

Share with others

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *