রাজু ভাস্কর্যের ইতিহাস

মূলত ১৯৯২ সালের ১৩ই মার্চ গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্যের সন্ত্রাস বিরোধী মিছিল চলাকালে সন্ত্রাসীরা গুলি করলে মিছিলের নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতা মঈন হোসেন রাজু নিহত হন। রাজুসহ সন্ত্রাস বিরোধী আন্দোলনের সকল শহীদের স্মরণে নির্মিত এই ভাস্কর্য ১৭ই সেপ্টেম্বর, ১৯৯৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য এ. কে. আজাদ চৌধুরী উদ্বোধন করেন। এই ভাস্কর্য নিমার্ণে জড়িত শিল্পীরা ছিলেন ভাস্কর শ্যামল চৌধুরী ও সহযোগী গোপাল পাল। নির্মাণ ও স্থাপনের অর্থায়নে ছিলেন – ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক আতাউদ্দিন খান (আতা খান) ও মুন্সীগঞ্জ-বিক্রমপুর সমিতির সভাপতি, লায়ন নজরুল ইসলাম খান বাদল। ভাস্কর্যটির সার্বিক তত্ত্বাবধানে রয়েছে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন।

১৯৯২ সালের সেই ১৩ মার্চের বর্ণনা:

“এদিকে পুলিশ অস্ত্রধারীদের কিছু না বলে উল্টো সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের সরে যেতে বলে। তখন রাজু ও তাঁর বন্ধুরা ডাসের (ঢাকা ইউনিভার্সিটি স্ন্যাকস) পূর্বদিকে টিএসসির দেয়ালের কাছে এসে দাঁড়ান। পুলিশের রমনা থানার তৎকালীন ওসি তাঁদেরও সরে যেতে বলেন, ‘তোমরা সরে যাও, আমরা দেখছি।’

রাজু প্রতিবাদী উত্তর দিয়ে বসেন পুলিশ কর্মকর্তার উদ্দেশে, ‘আপনারা কী দেখছেন তা তো আমরা সবাই দেখলাম। আপনার দুই পাশে থাকা সন্ত্রাসীদের কি চোখে পড়ছে না?’ পুলিশ কর্মকর্তা রাজুর দিকে আঙুল তুলে অন্য পুলিশদের আদেশ করতে থাকেন, ‘এই ছেলেকে ধর।’ রাজু উত্তেজিত হয়ে নিজের বুকের শার্টে হাত ধরে বলেন, ‘ধর আমাকে’।

মাহমুদ সেই উত্তপ্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলেন। তিনি রাজুকে টেনে নিয়ে আসেন টিএসসির ঠিক মাঝখানটায়। রাজু তখন রহিমের (তাঁদের সহপাঠী) দিকে আঙুল তুলে আদেশ করলেন, ‘স্লোগান ধর রহিম।’ রহিম জিজ্ঞেস করলেন কোন সংগঠনের ব্যানারে মিছিলটা হবে। রাজু বললেন গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্যের নামে স্লোগান দিতে।

শুরু হলো রাজুদের মিছিল। ‘সামনের সারিতে ছিলাম আমরা পাঁচজন। আমার ডানে রাজু। ঠিক ভাস্কর্যের মতোই হাতে হাত ধরে আমরা এগোচ্ছিলাম।’ বলেন মাহমুদ।

তাঁদের ১০-১২ জনের মিছিলটি টিএসসির পূর্ব গেট ধরে ডাস (ঢাকা ইউনিভার্সিটি স্ন্যাকস) ঘুরে হাকিম চত্বরের পাশ দিয়ে বর্তমান রাজু ভাস্কর্য ঘুরে টিএসসিতে অবস্থান নেয়। তখন মিছিল বিশাল আকার ধারণ করেছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা এসে যোগ দিয়েছে। এরপর আবার ঘুরে টিএসসির পশ্চিম দিকের সিঁড়িঘরের সামনে মিছিলটি থামে। নেতা-কর্মীরা সমাপনী বক্তব্য দিতে থাকেন।

ঠিক সেই মুহূর্তে আবার গোলাগুলি শুরু হয়। রাজু ও মিছিলের সঙ্গীরা সিদ্ধান্ত নেন সাহসী প্রতিবাদের। এগিয়ে যান আবারও একই পথে। স্বোপার্জিত স্বাধীনতা ভাস্কর্য অতিক্রম করে কিছু দূর যাওয়ার পর এক রাউন্ড গুলি হয়। রাজু চিৎকার করে মাহমুদকে বলে ওঠেন, ‘ওরা মিছিলের ওপর গুলি করেছে।’ পরমুহূর্তে আরেক রাউন্ড গুলি। রাজু তাঁকে টান দিলেন। মাহমুদ ভাবলেন, রাজু শুয়ে পড়ার জন্য তাঁকে টানছেন। মাহমুদ হাঁটু গেড়ে বসতেই রাজু হেলে পড়লেন মাহমুদের কাঁধে। তাঁর চোখ জোড়া তখন উল্টে গেছে।

মাহমুদ সেই করুণ মুহূর্তের কথা বলে যান ধরা গলায়, ‘রাজুকে জড়িয়ে ধরে দেখলাম ওর হাত বেয়ে রক্ত ঝরছে। মুহূর্তেই বুঝলাম রাজু গুলিবিদ্ধ।’ পাশেই ছিল পুলিশ। সাহায্য চাইলেন মাহমুদ। পুলিশ উল্টো দিকে দৌড় দিল। গিয়ে তাঁদের দিকেই টিয়ার শেল ছুড়ল।

মিনিট পাঁচেক কেটে গেল। ধোঁয়া আর অন্ধকারের মধ্যেই মাহমুদ দেখতে পেলেন, ডাসের দিক থেকে দুজন এগিয়ে আসছেন। রাজুকে তাঁরা কোলে করে রিকশায় তুলে নিলেন। গুলিবিদ্ধ রাজুকে নিয়ে ছুটলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

ঠিক এভাবেই প্রথম আলোর কাছে ১৯৯২ সালের সেই ১৩ মার্চের বর্ণনা করছিলেন শহীদ মঈন হোসেন রাজুর বন্ধু আবদুল্লাহ মাহমুদ খান।

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে বারংবার আর ত্যাগের বিনিময়ে মানুষও ফিরে পায় তাদের অধিকার।

Share with others

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *